বর্তমানে আমাদের জীবনযাত্রায় মোবাইল ফোনের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং আমাদের বিনোদন, তথ্য এবং সামাজিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার ক্রমশ একটি গুরুতর আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে, যা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাসে, অফিসে, এমনকি পারিবারিক আড্ডাতেও আমরা প্রায়শই স্ক্রিনে ডুবে থাকি, যা আমাদের মুখোমুখি কথোপকথন এবং সম্পর্ককে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এই আধুনিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে, বিশেষজ্ঞরা TIME পদ্ধতির মতো কার্যকরী কৌশল প্রস্তাব করেছেন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা প্রযুক্তির সাথে একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি।
আসক্তি কেন হয় এবং এর সমাধান কী?
স্মার্টফোনের নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্ককে ডোপামিন নামক হরমোন নিঃসরণে উৎসাহিত করে, যা আমাদের আনন্দ ও তৃপ্তির অনুভূতি দেয়। এর ফলে আমরা বারবার ফোন ব্যবহার করতে চাই, যা একসময় আসক্তিতে পরিণত হয়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ-এর (NIMH) গবেষণা অনুযায়ী, একজন মানুষ দিনে গড়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা নিঃসন্দেহে আসক্তির লক্ষণ।
এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে মনোবিজ্ঞানীরা একটি সহজ চার-ধাপের কৌশল, TIME পদ্ধতি, ব্যবহারের পরামর্শ দেন:
T = Time (সময় নির্ধারণ)
আমরা প্রায়শই উদ্দেশ্যহীনভাবে মোবাইল ব্যবহার করে মূল্যবান সময় নষ্ট করি। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ইমেইল দেখার জন্য ১৫ মিনিট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ২০ মিনিট সময় রাখা যেতে পারে। এর জন্য আপনি ফোনের বিল্ট-ইন স্ক্রিন টাইম ফিচার অথবা অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন, যা আপনাকে সাপ্তাহিক ব্যবহারের একটি পরিষ্কার হিসাব দেবে।
I = Intention (উদ্দেশ্যপূর্ণ ব্যবহার)
ফোন হাতে নেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন: "আমি কী কারণে ফোন ব্যবহার করছি?" খবর পড়া, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা বা প্রয়োজনীয় তথ্য খোঁজা যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়, তবে তা ঠিক আছে। কিন্তু যদি আপনি শুধু সময় কাটানোর জন্য স্ক্রল করতে থাকেন, তবে নিজেকে আবার প্রশ্ন করুন: "এটি কি আমার জন্য সত্যিই উপকারী?" যদি উত্তর ‘না’ হয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যবহার বন্ধ করুন।
M = Mindfulness (সচেতন ব্যবহার)
মোবাইল ব্যবহার করার সময় আমরা প্রায়শই বিজ্ঞাপন, অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বা নিউজফিডের ফাঁদে পড়ি। এই অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভিড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সচেতন থাকা জরুরি। ফোনের সেটিংসে গিয়ে নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন এবং কেবল আপনার প্রয়োজনীয় অ্যাপগুলো ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিন। এটি আপনাকে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এবং সময়ের অপচয় থেকে রক্ষা করবে।
E = Experience (অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন)
প্রতিবার মোবাইল ব্যবহারের পর নিজের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করুন। এটি কি আপনাকে নতুন কিছু শিখিয়েছে, নাকি শুধু সময় নষ্ট হয়েছে? যদি কোনো ইতিবাচক ফল না পান, তবে পরবর্তীবার সেই কাজে সময় ব্যয় না করার সিদ্ধান্ত নিন। এতে আপনি অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবেন।
আসক্তি কমানোর কিছু সহজ উপায়
- প্রযুক্তিমুক্ত স্থান: আপনার বাড়ির অন্তত একটি ঘরকে প্রযুক্তিমুক্ত রাখুন। সেখানে বই পড়ুন, মেডিটেশন করুন বা পরিবারের সাথে গল্প করুন।
- এক সময়ে একটি ডিভাইস: টিভি দেখা বা ল্যাপটপে কাজ করার সময় মোবাইল ফোনটি দূরে রাখুন। একই সময়ে একাধিক ডিভাইসে মনোযোগ দেওয়া আপনার কাজের গুণগত মান কমিয়ে দেয়।
- পরিবার ও বন্ধুত্বের প্রাধান্য: যখন পরিবার বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটাবেন, তখন ফোনটি পাশে রাখবেন না। মানুষের সাথে মুখোমুখি কথোপকথন আপনার মানসিক শান্তিকে বাড়িয়ে তোলে।
- ঘুমের আগে ফোন বন্ধ: ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে ফোন বন্ধ করে রাখুন। এর পরিবর্তে বই পড়ুন বা হালকা কিছু গান শুনুন। এটি আপনার মস্তিষ্কের শান্তিতে সহায়তা করবে এবং ঘুমের গুণগত মান উন্নত করবে।
মনে রাখবেন, মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের একটি সহায়ক অংশ, এটি জীবনের কেন্দ্রবিন্দু নয়। সচেতনভাবে ব্যবহার করলে এটি একটি আশীর্বাদে পরিণত হতে পারে, যা আমাদের জীবনকে আরও সহজ এবং উন্নত করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
- ডা. জেনিস কমার, ডিরেক্টর অফ ক্লিনিক্যাল রিসার্চ, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়: "মোবাইল আসক্তি কমাতে ব্যবহারকারীকে সচেতন হতে হবে। এটি একটি Behavioral change, যা সময়ের সাথে অভ্যাসে পরিণত হয়।"
- সাইকোলজিস্ট ড. ক্যাথরিন স্টেইনার-আদামস, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়: "আমরা প্রায়শই Boredom থেকে মোবাইল ব্যবহার করি। একটি Healthy alternative খুঁজতে হবে।"
0 Comments